এ বিষয়ে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. নিজামুল হক ভূইয়া বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা অনেক আগেই প্রত্যাখ্যান করেছে। সরকার এটি প্রত্যাখ্যান না করলে আমরা কর্মবিরতির মতো কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করতে বাধ্য হবো।
জানা গেছে, আগামী ১ জুলাই বা তার পরে রাষ্ট্রায়ত্ত-স্বায়ত্তশাসিত ও সমজাতীয় প্রতিষ্ঠানে যোগ দেওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনার আওতায় আসবেন। তারা বিদ্যমান পেনশনের বদলে সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির ‘প্রত্যয়’ স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হবেন। গত বৃহস্পতিবার এ সংক্রান্ত পৃথক দুটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘মূল বেতনের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ বা সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা- এ দুয়ের মধ্যে যেটি কম, সংশ্লিষ্ট সংস্থা তা চাকরিজীবীর বেতন থেকে কেটে রাখবে এবং সমপরিমাণ অর্থ সংস্থা দেবে। দুই অঙ্ক একত্রে চাকরিজীবীর পেনশন আইডির (পরিচয় নম্বর) বিপরীতে সর্বজনীন পেনশন তহবিলে জমা করবে। যেদিন প্রতি মাসের বেতন দেওয়া হয়, তার পরের কর্মদিবসের মধ্যেই কাজটি করতে হবে। এ জমা অর্থের পরিমাণ ও মেয়াদের ভিত্তিতে অবসরকালীন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী পেনশন ভোগ করবেন।’
নতুন এ সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়েছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। তারা বলছেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সব মিলিয়ে শিক্ষক রয়েছেন প্রায় ১৬ হাজার। কর্মকর্তা মিলিয়ে এ সংখ্যা ৩০ হাজারের বেশি। কর্মচারী ধরলে সব মিলিয়ে এ সংখ্যা চার লাখে দাঁড়াবে। অথচ সরকারি অন্যান্য চাকরিজীবীর সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি। তবে তাদের ক্ষেত্রে আগের নিয়মেই পেনশন ব্যবস্থা চালু রাখা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন শাখার এক শিক্ষক সূত্রে বলেন, সরকারের এ সিদ্ধান্ত সর্বজনীন হয়নি। পুলিশ, র্যাবসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য সংখ্যা সব মিলিয়ে ১৭ লাখ। তাদের সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনা হয়নি। অথচ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে এর আওতায় আনা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। দ্রুত এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা না হলে শিক্ষকরা রাস্তায় নেমে আসবেন।
এ বিষয়ে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলেন, পেনশন ব্যবস্থা নিয়ে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা প্রত্যাহার করতে হবে। সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার না হলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে। এ বিষয়ে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী কর্মসূচি ঠিক করা হবে।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. আবু তাহের বলেন, এই সর্বজনীন পেনশন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে হতাশা ও অসন্তুষ্টি সৃষ্টি হয়েছে। এই প্রজ্ঞাপন কার্যকর হলে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা চরম বৈষম্যের শিকার হবেন।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. আলমগীর কবির বলেন, সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্ত অগ্রহণযোগ্য ও একচোখা। যদি এ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না হয় তাহলে সামনে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জিনাত হুদা বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি এই পেনশন ব্যবস্থাপনা প্রত্যাহারের জোর দাবি জানাচ্ছে। এটি বৈষম্যমূলক। জাতির পিতা আমাদের স্বায়ত্তশাসন দিয়েছেন, নিজস্ব বেতন কাঠামো থেকে শুরু করে নিজস্ব পেনশন সিস্টেম সব ক্ষেত্রেই আমাদের স্বায়ত্তশাসন দিয়েছেন। সুতরাং নতুন এই সর্বজনীন পেনশন সিস্টেমকে আমরা গ্রহণ করতে পারি না।
তিনি আরও বলেন, আমাদের বেতন কম, কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই এবং সর্বশেষ যে পেনশন সেটাও যদি একটি অভিন্ন নীতিমালায় চলে যায়, সবার জন্য একই হয়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে মেধাবীরা কেন আসবে? স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে করতে হলে স্মার্ট শিক্ষাব্যবস্থার পাশাপাশি সবার আগে প্রয়োজন শিক্ষা এবং শিক্ষক বান্ধব নীতি।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের মহাসচিব অধ্যাপক ড. মো. আখতারুল ইসলাম বলেন, সর্বজনীন পেনশন নিয়ে যে প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে তা নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে। সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এটি প্রত্যাখ্যান করেছেন। রমজানের কারণে এখন কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হচ্ছে না। আগামী সপ্তাহে সব বিশ্ববিদ্যালয় এই পেনশন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিবৃতি দেবে।
তিনি আরও বলেন, আমরা একটি সাব কমিটি করেছি। এই কমিটিতে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক রয়েছেন। তাদের নিয়ে আমরা পরবর্তীতে সভা করে কর্মসূচি চূড়ান্ত করব। তবে আমরা আশা করছি এর আগেই সরকার আমাদের সঙ্গে আলোচনায় বসে বিষয়টি সমাধান করবেন। আমরা চাই না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হোক। শিক্ষকরা আন্দোলনে নামতে মানসিকভাবে প্রস্তুত রয়েছে বলেও জানান তিনি।
জানা গেছে, কর্তৃপক্ষ, কর্পোরেশন, কমিশন, সংস্থা, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ইনস্টিটিউশন, কাউন্সিল, একাডেমি, ট্রাস্ট, বোর্ড, ফাউন্ডেশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ), জীবন বীমা কর্পোরেশন, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট, শিক্ষা বোর্ড, পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনসহ (পিকেএসএফ) প্রায় ৪০০ প্রতিষ্ঠান সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনার আওতায় আসবে।
সার্বিক বিষয়ে অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান বলেন, সব নাগরিককে পেনশনের আওতায় আনতেই সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি চালু করা হয়েছে। এ উদ্দেশ্যেই কাজ করছে সরকার। সার্বিকভাবে বৃহত্তর স্বার্থের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্টরা এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা থেকে সরে আসবেন বলে আশা করছি।