রমজান মাস মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি শুধু সিয়াম সাধনার মাসই নয়, বরং এটি সেই মাস, যখন মহান আল্লাহ তাআলা মানবজাতির জন্য হিদায়াতরূপে পবিত্র কোরআন নাজিল করেছেন। কোরআনের সঙ্গে রমজানের গভীর সম্পর্ক থাকায় একে ‘কোরআনের মাস’ হিসেবেও অভিহিত করা হয়।
রমজান ও কোরআন নাজিলের সম্পর্ক
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘রমজান মাস, যে মাসে কোরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে, যা মানুষের জন্য হিদায়াত এবং সুস্পষ্ট পথনির্দেশ ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৮৫)
এই আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, রমজান শুধু রোজার মাস নয়, বরং এটি ইসলামের সর্বোচ্চ জীবনবিধান কোরআন নাজিলের মাস।
ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) লোকদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা দানশীল ছিলেন আর রমজান মাসে যখন জিবরাইল (আ.) তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করতেন তখন তিনি আরো বেশি দানশীল হয়ে যেতেন। জিবরাইল (আ.) রমজানের প্রত্যেক রাতে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত্ করতেন। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে কোরআন পাঠ করে শোনাতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে যখন জিবরাইল (আ.) দেখা করতেন, তখন তিনি মানুষের কল্যাণে প্রেরিত বায়ুর চেয়েও অধিক দানশীল হতেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩২২০)
এ থেকেই বোঝা যায় যে রমজান মাসে কোরআন অধ্যয়ন ও তেলাওয়াতের গুরুত্ব কতখানি।
তারাবির নামাজে কোরআন তেলাওয়াত
রমজানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হলো তারাবিহ নামাজ, যেখানে কোরআনের দীর্ঘ তিলাওয়াত করা হয়। সাহাবায়ে কেরাম, তাবেইন ও আগের মুসলিম মনীষীরা রমজানে সম্পূর্ণ কোরআন খতম করতেন এবং অধিক পরিমাণে তেলাওয়াত করতেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি রমজানের রাতে ঈমানসহ সাওয়াবের আশায় রাত জেগে ইবাদত করে, তার আগের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩৭)
তাহাজ্জুদে কোরআন তেলাওয়াত
অনেকের জন্য সারা বছর তাহাজ্জুদের নামাজ পড়া সম্ভব হয় না বা পড়তে পারে না। কিন্তু রমজানের এই সুবর্ণ সুযোগে প্রতিদিন রাতে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করা সম্ভব। এর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভ করা। তাহাজ্জুদের কোরআন তিলাওয়াতের বিশেষ ফজিলত রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ুন। এটা আপনার জন্য অতিরিক্ত নফল। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা আপনাকে প্রশংসিত স্থানে সমাসীন করবেন।’ (সুরা : ইসরা/বনি ইসরাইল, আয়াত : ৭৯)
কোরআনের আলোকে জীবন গঠন
রমজান শুধু রোজা ও ইবাদতের মাস নয়, বরং এটি আত্মগঠনের মাস। কোরআন আমাদের জীবনের সবক্ষেত্রে দিকনির্দেশনা দিয়েছে। তাই রমজান মাসে কোরআন অধ্যয়ন করে আমরা আমাদের জীবনকে কোরআনের আলোকে গড়ে তুলতে পারি। কারণ, রমজান মাসে শুধু কোরআন তেলাওয়াত করাই যথেষ্ট নয়, বরং এর অর্থ ও ব্যাখ্যা বোঝাও জরুরি। কোরআনের নির্দেশনা অনুসারে আমরা যদি আমাদের জীবন পরিচালনা করি, তবে এটি শুধু দুনিয়াতেই নয়, আখিরাতেও আমাদের জন্য সফলতা বয়ে আনবে। আলী (রা.) বলেন, ‘হে ইলমের ধারক-বাহকরা, কোরআনের ধারক-বাহকরা, তোমরা কোরআন অনুযায়ী আমল করো। কারণ প্রকৃত আলিম সে, যে ইলম অনুযায়ী আমল করে। যার ইলম ও আমলের মধ্যে সাদৃশ্য থাকে। অচিরেই তোমরা এমন এক জাতি দেখতে পাবে, কোরআন যাদের কণ্ঠ স্পর্শ করে ভেতরে প্রবেশ করবে না। তারা ইলম অনুযায়ী আমল করবে না। তাদের ভেতর-বাহির এক থাকবে না। তারা বিভিন্ন বৈঠকের আয়োজন করে গোলাকার বৃত্ত বানিয়ে বসবে। অতঃপর বিভিন্ন আলোচনার মাধ্যমে নিজেকে এ বলে শ্রেষ্ঠরূপে তুলে ধরতে চাইবে, আমি কুরআন সবার থেকে বেশি বুঝি। যখন নিজের কোনো সঙ্গীকে অন্যের সাথে বসতে দেখবে, এতে তারা রাগান্বিত হবে এবং তাকে পরিত্যাগ করবে। তাদের এই আলোচনা তাদের বৈঠক পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকবে। তা আল্লাহ তাআলা পর্যন্ত পৌঁছাবে না।’ (মুসনাদে দারিমি, হাদিস : ৩৯৪)
রাতের আঁধারে কোরআন তেলাওয়াত
কোনো জিনিস পড়ে তা উপলব্ধি করা, তার থেকে উপকৃত হওয়া এবং তা আত্মস্থ করার সবচেয়ে উত্তম সময় হচ্ছে রাতের শেষ অংশ। তাই রমজানে রাতের বেলায় কোরআন তেলাওয়াতের বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই ইবাদতের জন্য রাতে ওঠা প্রভৃতি দলনে সহায়ক এবং (তিলাওয়াত ইত্যাদির ক্ষেত্রে) স্পষ্ট উচ্চারণের অনুকূল।’ (সুরা : মুজাম্মিল, আয়াত : ৬)
রমজান মাসে কোরআন চর্চার কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক
১. নিয়মিত তেলাওয়াত করা : প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ তেলাওয়াতের পরিকল্পনা করা উচিত।
২. অর্থ ও তাফসির বোঝা : কোরআনের অর্থ ও তাফসির বোঝার চেষ্টা করা উচিত, যাতে আমরা কোরআনের মর্মার্থ অনুধাবন করতে পারি।
৩. আমল করা : কোরআনের শিক্ষা জীবনে বাসত্মবায়ন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৪. পরিবার ও সমাজে প্রচার : কোরআনের জ্ঞান পরিবার ও সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া উচিত, যাতে সবাই এই মহামূল্যবান শিক্ষাগুলো অর্জন করতে পারে।
৫. রমজানের শেষ দশকের গুরুত্ব: কদরের রাত (লাইলাতুল কদর) রমজানের শেষ দশকে অবস্থিত। কোরআন এই রাতেই নাজিল হয়েছে। এই রাতকে হাজার মাসের চেয়ে উত্তম বলা হয়েছে। (সুরা কদর)। এজন্য, শেষ দশকে ইবাদত ও কোরআন চর্চার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
তাই আমরা কোরআন অধ্যয়ন, তেলাওয়াত, অনুধাবন ও আমলের মাধ্যমে আমরা এই মাসের পূর্ণ ফজিলত অর্জন করতে পারি।