স্বাধীনতার সুবাতাস মানুষের হৃদয়ে যে গভীর স্পন্দন তোলে, তা কোনো একদিনের আবেগে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি একটি জাতির আত্মপরিচয়, আত্মমর্যাদা ও অস্তিত্বের জাগরণ। নিজস্ব ভূখণ্ড, পতাকা ও সার্বভৌমত্বের মধ্যেই একটি জাতির সম্মান, নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিহিত থাকে। সেই গৌরবময় স্বাধীনতার চূড়ান্ত অর্জন—১৬ ডিসেম্বর—বাংলা জাতির ইতিহাসে এক অনন্য মাহেন্দ্রক্ষণ।
পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর যে আনন্দ, তা কেবল তারাই অনুভব করতে পারে, যারা দীর্ঘ ত্যাগ, রক্ত ও অশ্রুর পথ পেরিয়ে বিজয়ের আলো স্পর্শ করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ছিল তেমনই এক রক্তস্নাত অধ্যায়ের সমাপ্তি ও নতুন সূর্যের উদয়। দীর্ঘ নয় মাসের সীমাহীন আত্মত্যাগ, সাহস ও দৃঢ়তার বিনিময়ে অর্জিত এই বিজয় কেবল সামরিক সাফল্য নয়; এটি মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে দানকৃত এক নিয়ামত।
সব বিজয় এক নয়
ইতিহাস বিজয়ের কাহিনিতে ভরপুর হলেও সব বিজয়ের প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য এক নয়। কোনো বিজয় জন্ম নেয় ক্ষমতার লোভ ও দম্ভ থেকে, যেখানে জনপদ ধ্বংস হয়, মানবতা পদদলিত হয়। আবার কোনো বিজয় সত্য, ন্যায় ও মানবকল্যাণের আদর্শ বহন করে। ইসলাম আমাদের শিক্ষা দেয়—প্রকৃত বিজয় শত্রুকে পরাস্ত করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং ইনসাফ প্রতিষ্ঠা, মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মধ্যেই তার পূর্ণতা।
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ধর্মের নাম ব্যবহার করে যখন অন্যায়, বৈষম্য ও জুলুমের শাসন কায়েম করেছিল, তখন সেই মুখোশ উন্মোচন করা ছিল ঈমানি দায়িত্ব। দীর্ঘ ২৪ বছর ধরে পূর্ব বাংলার মানুষের ওপর চালানো বৈষম্য, শোষণ ও নিপীড়নের চরম প্রকাশ ঘটে ১৯৭১ সালে। নয় মাসব্যাপী সংঘটিত সেই গণহত্যায় শহীদ হন অসংখ্য মানুষ, সম্ভ্রম হারান অগণিত মা-বোন, আর দেশের মাটি রঞ্জিত হয় শ্রেষ্ঠ সন্তানদের রক্তে।
কোরআনের আলোকে বিজয়ের শিক্ষা
পবিত্র কোরআনে স্বার্থনির্ভর বিজয়ের ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে বলা হয়েছে—
“রাজা-বাদশাহরা যখন কোনো জনপদে প্রবেশ করে, তখন তা ধ্বংস করে দেয় এবং সেখানকার সম্মানিত লোকদের অপমানিত করে।”
(সুরা নামল : ৩৪)
পাকিস্তানি শাসকদের আচরণ ছিল এই আয়াতেরই বাস্তব প্রতিচ্ছবি। অথচ ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পর স্বাধীন বাংলাদেশে প্রতিশোধের কোনো রক্তপাত হয়নি। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখো মানুষের উপস্থিতিতে উড়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা, আর পরাজিত হানাদারদের প্রতি ঘোষণা করা হয়েছিল সাধারণ ক্ষমা। এটাই আদর্শবাদী বিজয়ের সৌন্দর্য।
মক্কা বিজয় ও আমাদের বিজয়
ইতিহাসের আরেক মহান বিজয়—মক্কা বিজয়ের দিন রাসুলুল্লাহ (সা.) ঘোষণা করেছিলেন,
“আজ প্রতিশোধের দিন নয়, আজ দয়া ও করুণার দিন।”
দীর্ঘ নির্যাতনের পরও তিনি শত্রুদের ক্ষমা করেছিলেন।
বাংলাদেশের বিজয় দিবসের চিত্রও সেই মহান আদর্শেরই প্রতিধ্বনি। এটি প্রমাণ করে—আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল হকের পক্ষে, ন্যায় ও মানবতার পক্ষে এক ঐতিহাসিক সংগ্রাম।
বিজয় দিবসে মুমিনের করণীয়
বিজয় মানে কেবল উল্লাস নয়; বিজয়ের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে কৃতজ্ঞতা ও দায়িত্ববোধ। আল্লাহ তায়ালা বলেন—
“যাদের আমি পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা দান করি, তারা নামাজ কায়েম করবে, জাকাত আদায় করবে, সৎকাজের আদেশ দেবে এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে।”
(সুরা হজ : ৪১)
এই আয়াত আমাদের বিজয়ের প্রকৃত উদ্দেশ্য স্পষ্ট করে দেয়। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া বীর সন্তানরা এ জাতির শ্রেষ্ঠ গর্ব। তাদের রক্তের বিনিময়েই আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। তাই বিজয়ের দিনে আমাদের কর্তব্য শুধু আনন্দ করা নয়; শহীদদের জন্য দোয়া করা, তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করা এবং যে আদর্শ নিয়ে তারা জীবন উৎসর্গ করেছেন—তা বাস্তব জীবনে ধারণ করা।
বিজয়ের প্রকৃত কৃতজ্ঞতা
অতএব, আমাদের অর্জিত এই স্বাধীনতা কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়; এটি মহান আল্লাহ তায়ালার বিশেষ অনুগ্রহ। এই নিয়ামতের প্রকৃত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পায় ন্যায়, সততা ও ইনসাফভিত্তিক সমাজ গঠনে। ব্যক্তি জীবনে নৈতিকতা, সমাজজীবনে মানবিকতা এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাই হবে বিজয়ের সার্থকতা।
এই বিজয় যেন কেবল অতীতের গৌরবগাথা হয়ে না থাকে; বরং ভবিষ্যতের জন্য পথনির্দেশক আলোকবর্তিকায় পরিণত হয়—এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।