মহান আল্লাহ তা’আলার অপার রহমত, আল্লাহর রহমত লাভের অপার সুযোগ, মুসলমানদের আকূল আর্জির রাত পবিত্র লাইলাতুল কদর। যে রাতে মানবজাতির মুক্তির সনদ পবিত্র কোরআন নাজিল হয়েছিলো, যে রাতের জন্য আল্লাহ একটি সুরা নাজিল করেছেন, যে রাত হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম- সেই আরাধ্য মহিমান্বিত রজনী হলো লাইলাতুল কদর। এই রাতকে আমরা শবে কদর বলেও অভিহিত করি। এই রাতের ইবাদত সর্বাপেক্ষা উত্তম। তাই এই রাত সম্পর্কে জানা আমাদের অত্যন্ত জরুরী।
মুসলিম উম্মা’র জন্য এক অনন্য নেয়ামত লাইলাতুল কদর। ‘লাইলাতুল কদর’ আরবি শব্দ। শবে-কদর হলো ‘লাইলাতুল কদর’ এর ফারসি পরিভাষা। কয়েক শতাব্দী মুঘল শাসন এবং উপমহাদেশে রাজকীয় ভাষা ফারসি থাকার কারণে ধর্ম, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও বিচার-আচারের বহু ফারসি শব্দ আমাদের সংস্কৃতির সাথে একাকার হয়ে গেছে। ‘সালাতের’ পরিবর্তে নামাজ, ‘সাওমের’ পরিবর্তে রোজার মতো লাইলাতুল কদর এর ফারসি পরিভাষা শবে কদর সাধারণ মানুষের কাছে তাই বেশি পরিচিত। তবে উভয় ভাষাতেই এই রাতের অর্থ একই দাঁড়ায়। তাই শবে কদর তথা লাইলাতুল কদর অর্থ হ”েছ সম্মানিত ও মহিমান্বিত রাত বা মর্যাদার রাত। এ ছাড়া এর অন্য অর্থ হলো- ভাগ্য, পরিমাণ ও তাকদির নির্ধারণ করা। ইসলাম ধর্ম অনুসারে, এ রাতে মুসলমান তথা ইসলামের মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) এর উম্মতদের সম্মান বৃদ্ধি করা হয় এবং মানবজাতির ভাগ্য পুননির্ধারণ করা হয়।
পবিত্র কোরআনের বর্ণনা অনুসারে, আল্লাহ এই রাত্রিকে অনন্য মর্যাদা দিয়েছেন এবং এই একটি মাত্র রজনীর ইবাদত হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও অধিক সওয়াব অর্জিত হওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি তা (আল-কোরআন) নাজিল করেছি কদরের রাতে। আপনি কি জানেন, লাইলাতুল কদর কী? লাইলাতুল কদর হলো হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ রজনী। এই রাতে প্রতিটি কাজের জন্য ফেরেশতা ও রুহ তাদের প্রতিপালকের আদেশে অবতীর্ণ হয়। শান্তি, যা বিরাজ করে সেই রাতের ফজর পর্যন্ত (সুরা কদর, আয়াত : ১-৫)।’ ইসলামী স্কলারদের মতে, এক হাজার মাস মানে হলো ৮৩ বছর ৪ মাস। বলা হয়েছে হাজার মাসের চেয়েও বেশি অর্থাৎ এই এক রাতের ইবাদত ৮৩ বছর ৪ মাসের চেয়েও অনেক বেশি পূণ্যের। কত বছরের ইবাদতের সমান সেটি একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন। কারণ, সূরায় এক হাজার মাস বলা হয়নি। বলা হয়েছে হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। হাজার মাস মানে কেবল এক হাজার মাস নয়, তার চেয়েও অধিক মাস বোঝাতেই হাজার মাস বলা হয়েছে।
পবিত্র ও মহিমান্বিত লাইলাতুল কদর মাহে রমজানের কত তারিখে, সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট করা হয়নি। উম্মুল মুমিনিন হযরত আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত হাদিসে উল্লেখ আছে, প্রিয় নবী (স.) রমজানের শেষ দশকে অর্থাৎ ২০ রমজান থেকে শেষ দশদিন লাইলাতুল কদর সন্ধান করতে বলেছেন। তাই লাইলাতুল কদর লাভ করার সর্বোত্তম উপায় হলো শেষ দশকে ইতেকাফ করা। ইমাম বুখারি, ইমাম মুসলিম, ইমাম আহমদ ও ইমাম তিরমিযী কর্তৃক বর্ণিত হাদিসে বলা হয়েছে, হযরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেছেন, নবী করীম (স.) বলেছেন, ‘কদরের রাতকে রমজানের শেষ দশ রাতের কোনো বিজোড় রাতে খোঁজ কর’। হযরত আবু বকর (রা.) ও হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিস থেকেও এ একই ধরণের তথ্য পাওয়া যায়।
তবে কোনো কোনো ইসলামি মনীষী নিজস্ব ইজতিহাদ, গবেষণা, গাণিতিক বিশ্লেষণ ইত্যাদির মাধ্যমে রমজানের ২৭ তারিখের রাতে অর্থাৎ ২৬ রোজার দিবাগত রাতে শবে কদর হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনার কথা জোর দিয়ে বলেছেন। কিš‘ রাসূলুল্লাহ (স.) এটিকে সুনির্দিষ্ট করেননি বরং কষ্ট করে বিজোড় রাত্রিতে খুঁজে নিতে বলেছেন। আরবী তারিখ শুরু হয় সূর্যাস্তের পর থেকে। ফলে বিজোর রাত হবে জোড় রমজানের শেষে। অর্থাৎ ২০, ২২, ২৪, ২৬ এবং ২৮ রমজানের ইফতারের পর থেকে এই বিজোড় রাতগুলো পাওয়া যাবে।
অবশ্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) লাইলাতুল কদরের রাত চেনার ৭টি নিদর্শনের কথা বলেছেন। এগুলো হলো- ১. রাতটি গভীর অন্ধকারে ঢাকা থাকবেনা। ২. রাতটি নাতিশীতোষ্ণ হবে। ৩. মৃদ বাতাস প্রবাহিত থাকবে। ৪. সেই রাতে ইবাদত করে মানুষ অপেক্ষাকৃত বেশি তৃপ্তিবোধ করবে। ৫. কোনো ইমানদার ব্যক্তিকে আল্লাহ তা’আলা স্বপ্নে হয়তো তা জানিয়ে দিতে পারেন। ৬. এই রাতে বৃষ্টি বর্ষিত হবে। ৭. সকালে হালকা আলোকরশ্মিসহ সূর্যোদয় হবে, যা হবে পূর্ণিমার চাঁদের মতো।
সবদিক বিবেচনাতেই ২৬ রমজান শেষে রাতে লাইলাতুল কদর প্রাপ্তির সম্ভাবনা রয়েছে। আজ ২৬ রমজান সেই সুবর্ণ দিন। সরকারিভাবেও আজকের রাতকে শবে কদরের রাত হিসেবে উদযাপন করা হবে। ২০ রমজানের পরে আমরা যারা কদরের রাতের তালাশ করতে ব্যর্থ হয়েছি, তাদের কাছে আর সুযোগ আছে কেবল আজকের রাত এবং ২৮ রমজান শেষের রাত।
লাইলাতুল কদর পাওয়ার জন্য মুমিন মুসলমান রমজানের শেষ দশকে বেশি বেশি নফল নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত, দুরুদ ও সালাম, তওবা-ইস্তেগফার, দান-সদকা ইত্যাদি কাজের মধ্যে নিজেকে মগ্ন রাখেন। রাত জেগে ইবাদত অর্থাৎ কিয়ামুল লাইল করে থাকেন।
‘কিয়ামুল লাইল’ অর্থ হল রাত্রী জাগরণ। মহান আল্লাহর জন্য আরামের ঘুম স্বে”ছায় হারাম করে রাত জেগে ইবাদত করা আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের একটি গুণ। মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাদের পরিচয় দিয়েছেন এভাবে ‘তারা রাত্রী যাপন করে রবের উদ্দেশ্যে সিজদাবনত হয়ে ও দাঁড়িয়ে থেকে।’(সূরা ফুরকান, আয়াত : ৬৪)
মুসনাদে আহমেদ গ্রšে’ হযরত ওবায়দা ইবনে সামেত বর্ণিত হাদিসে বর্ণিত হয়েছে- ‘নবী করীম (স.) বলেছেন- কদরের রাত রমজান মাসের শেষ দশ রাতে রয়েছে। যে ব্যক্তি উহার শুভফল লাভের উদ্দেশ্যে ইবাদতের জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে, আল্লাহ তার আগের পিছনের গুনাহ মাফ করে দিবেন।’ রাসুল (স.) রমজানের শেষ দশদিন মসজিদে এ’তেকাফে থাকতেন এবং ইবাদতে গভীর মনোনিবেশ করতেন। তাই আমরা কোনো একটা বিশেষ রাতকে নির্দিষ্ট না করে হাদিস অনুযায়ী অন্তত রমজানের শেষ দশ দিনের বিজোড় রাতগুলোতে লাইলাতুল কদরের সৌভাগ্য লাভের আশায় ইবাদতে মনোনিবেশ করতে হবে। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন- ‘যে ব্যক্তি এ রাত থেকে বঞ্চিত হবে সে সমগ্র কল্যাণ ও বরকত হতে বঞ্চিত হবে। এর কল্যাণ থেকে একমাত্র হতভাগ্য লোক ছাড়া আর কেউ বঞ্চিত হয় না।’ (মিশকাত)
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) লাইলাতুল কদরের রাতের মতো সারারাত জেগে অন্য দিন ইবাদতে মগ্ন থাকতেন না। এ রাতের জন্য আলাদা নিয়মের কোনো নামাজ নেই। অন্যান্য নফল নামাজের মতোই দুই-দুই রাকাত করে যত বেশি নামাজ পড়া যায়, সে চেষ্টা করতে হবে। তবে দ্রুত অধিক নামাজ পড়ার চেয়ে ধীরে সু¯ে’ কায়মনোবাক্যে নামাজ আদায় করতে হবে। এই নামাজে নির্দিষ্ট সংখ্যক বা নির্দিষ্ট কোনো সুরা পড়ার ব্যাপারে নির্দেশনা নেই। প্রতি রাকাতে সুরা ফাতিহার পর অন্য যেকোনো একটি বা একাধিক সুরা বা কোরআনের কোনো আয়াত পড়া যেতে পারে। তবে প্রতিটি রাকাত যতো বেশি দীর্ঘায়িত করা যায়, ততোই ভালো।
এছাড়া সালাতুল তাওবা, সালাতুল হাজত, সালাতুল তাসবিহ নামাজও পড়তে পারেন। রাতের শেষভাগে কমপক্ষে ৮ রাকাত তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার চেষ্টা আমরা অবশ্যই করব। কারণ এ নামাজ সর্বশ্রেষ্ঠ নফল নামাজ। আর রাতের এ অংশে দোয়া কবুল হয়। নফল নামাজের সংখ্যার হিসাবের চেয়ে নামাজের গুণগত দিকটির দিকে আমাদের বেশি লক্ষ্য রাখতে হবে।
হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, লাইলাতুল কদরের রাতে নবী (স.) এত দীর্ঘ এবং গভীরভাবে নামাজ পড়তেন যে, যখন তিনি দাঁড়িয়ে কেরাত পড়তে থাকতেন; মনে হতো যেন তিনি সিজদায় যাবেননা। আবার যখন রুকুতে গিয়ে এত বেশি তাসবিহ পড়তেন যেন আর দাঁড়াবেননা। আবার যখন দাঁড়িয়ে আল্লাহর প্রশংসা শুরু করতেন তখন মনে হতো আর সেজদায় যাবেননা। আবার যখন সেজদায় গিয়ে আল্লাহর প্রশংসা (তাসবিহ) করতে থাকতেন; যেন আর সেজদা থেকে উঠবেননা।
তাই আমাদেরও উচিৎ হুড়োহুড়ি করে নামাজ পড়ার চেয়ে একান্তে, নিবিঢ় মনোযোগে আল্লাহর কাছে গুনাহ মাফ চাওয়া, হায়াত ও রিজিক বাড়ানোর আর্জু পেশ করার মানসে ইবাদত করা। কারণ আল্লাহ আপনার ইবাদতের আনুষ্ঠানিকতা চাননা। তিনি চান তাঁর বান্দা কতোটা একান্ত হয়ে কেবল আল্লাহরই অনুগ্রহ লাভের নিয়তে নামাজ পড়বে।
পবিত্র লাইলাতুল কদরের রাতে নঢল নাজাজের পাশাপাশি হাদিসে যে সকল দোয়া ও জিকিরের অধিক ফজিলতের কথা বলা হয়েছে সেগুলো থেকে কয়েকটি নির্বাচিত করে অর্থ বুঝে বার বার পড়া যেতে পারে। ইস্তেগফার (ক্ষমা প্রার্থনা) ও দরুদ আল্লাহর কাছে খুবই প্রিয়। তাই বেশি বেশি ইস্তগফার, দরুদ ও তাসবিহ পড়া যেতে পারে। হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (স.) কে বললাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ যদি কোনো প্রকারে আমি জানতে পারি রাতটি লাইলাতুল কদর তাহলে কি দোয়া করবো? জবাবে নবী (স.) বলেন, “এ দোয়া পড়বে- আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন কারিমুন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নি।” অর্থাৎ ‘আয় আল্লাহ তুমি বড়ই ক্ষমা করণেওয়ালা এবং বড়ই অনুগ্রহশীল। ক্ষমা করে দেয়াই তুমি পছন্দ কর। অতএব তুমি আমাদের গুনাহগুলো ক্ষমা করে দাও।’
নামাজ শেষে এই দোয়াটিও বেশি বেশি পড়া যেতে পারে- “সুব্হানাল্লাহি ওয়াল হাম্দু লিল্লাহি ওয়া লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবর, লা হা’ওলা কুয়্যাতা ইল্লাবিল্লাহিল্ আলীয়্যিল আযীম”। বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াত এমনকি কোনো একটি আয়াত মুখস্ত করার পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। এ রাতে অর্থ বুঝে কুরআন পড়তে হবে। কুরআনের শিক্ষাকে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে প্রতিষ্ঠার শপথ গ্রহণ করতে হবে। যাদের কুরআনের উপর প্রয়োজনীয় জ্ঞান রয়েছে তাঁরা এ রাতে একটি দারসও প্র¯‘ত করতে পারেন।
সবচেয়ে বড় কথা- আপনি নিজেই নিজের পর্যালোচনা করুন। জীবনের ফেলে আসা দিনগুলোতে আল্লাহর কতগুলো হুকুম অমান্য করেছেন, আল্লাহর ফরজ ও ওয়াজিবগুলো কতটা পালন করেছেন এবং তা কতটা নিষ্ঠার সাথে করেছেন, ই”ছায় ও অনি”ছায় কি কি বড় গুনাহ আপনি করে ফেলেছেন, আল্লাহর গোলাম হিসাবে আল্লাহর দ্বীন পতিষ্ঠায় আপনি কতটুকু ভূমিকা রেখেছেন- এগুলো ভাবুন, যা কিছু ভালো করেছেন তার জন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করুন, আর যা হয়নি তার জন্য আল্লাহর ভয় মনে সৃষ্টি করে সত্যিকার তওবা করুন। এ রাতে নিরবে নিভৃতে কিছুটা সময় এ আত্মসমালোচনা করুন, দেখবেন আপনি সঠিক পথ খুঁজে পাবেন। আত্মসমালোচনা আমাদের বিবেককে জাগিয়ে তুলবে। আত্মসমালোচনা আত্মশুদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। মহান আল্লাহ বলেন- ‘হে ঈমানদার লোকেরা আল্লাহ তায়ালাকে ভয় কর এবং প্রত্যেক ব্যক্তির উচিত, আগামীকালের জন্য (পরকাল) সে কি প্রেরণ করেছে তা চিন্তা করা’(সূরা হাশর, আয়াত : ১৮)।
তাই আসুন, আমরা লাইলাতুল কদরের যথার্থ মর্ম উপলব্ধি করে বেশি বেশি ইবাদত-বন্দেগী করে আমাদের ব্যক্তি. পারিবারিক, রাষ্ট্রীয় ও বৈশ্বিক শান্তি, সমৃদ্ধির পথ তৈরিতে আত্মনিবেশ করি।
(এই লেখা বিশিষ্ট ইসলামী স্কলারগণের আলোচনা থেকে অনুপ্রাণীত এবং বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্য সন্নিবেশিত। ধর্মীয় মূল্যবোধের কোনো ব্যত্যয় হলে লেখক আন্তরিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থী)