বার্তা বিভাগ :
আজ শনিবার শোকাবহ ১৫ আগস্ট। জাতীয় শোক দিবস। ১৯৭৫ সালের এই দিনে মানব সভ্যতার ইতিহাসে নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের মধ্যে অন্যতম হলো ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা।
মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী ও পরাজিত দেশী, বিদেশি শক্তি এবং ঘাতক চক্র সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালের এই দিনে সপরিবারে হত্যা করেছিল। দিনটি বাঙালির জাতীয় শোক দিবস। ১৫ আগস্ট শনিবার জাতি শোকাতুর হৃদয়ে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে বঙ্গবন্ধুকে।
নির্যাতিত-নিপীড়িত পরাধীন বাঙালি জাতি ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতা লাভ করে। পর্বতসম সাহস আর সাগরের মতো হৃদয়ের অধিকারী শেখ মুজিব জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাঙালিকে পাকিস্তানের শোষণ-নির্যাতনের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেছিলেন। বাঙালির অধিকার আদায়ের আন্দোলন তথা স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের মুক্তি সংগ্রামের প্রেরণার উৎস হয়ে উঠেন। এজন্যই স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেও জাতির পথপ্রদর্শক হিসেবে আজও তিনি সবার হৃদয়ে।
১৯৪৭ সালে ভ্রান্ত দ্বিজাতিতত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান নামক অসম রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। ব্রিটিশ শাসনের অবসান হলেও স্বাধীন সত্তা নিয়ে সেদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি বাঙালি জাতি। বাঙালি জাতি ও তাদের ভূখণ্ডকে করা হয় পাকিস্তান রাষ্ট্রের অধীনস্থ। বাঙারির ওপর চেপে বসে পাকিস্তান রাষ্ট্রযন্ত্রের শাসন, শোষণ, অত্যাচার, নির্যাতন আর নিপীড়ন।
সেই নির্যাতিত বাঙালিকে সংগঠিত করে স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে ধাবিত হয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব হয়ে উঠেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা। ভূষিত হন বঙ্গবন্ধু উপাধিতে। এই আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে অত্যাচার, নির্যাতন, জেল-জুলুম সহ্য করতে হয়েছে। বার বার তাকে হতে হয়েছে মৃত্যুর মুখোমুখি।
বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ এ দেশের মুক্তিকামী মানুষ মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাঙালি অধিষ্ঠিত করে তাদের জাতির পিতার আসনে। বিশ্ববাসীর কাছেও বঙ্গবন্ধু পরিচিত হয়ে উঠেন নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের নেতা হিসেবে।
স্বাধীনতার পর দেশ পরিচালনায় বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ ও দূরদর্শী পদক্ষেপে বাংলাদেশ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে থাকে। দীর্ঘদিনের শোষিত-বঞ্চিত এ দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য তিনি দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এই সময়ও তিনি দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি হন। সব ষড়যন্ত্রকে পাশ কাটিয়ে তিনি সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। বঙ্গবন্ধুর এই সফলতা ও দেশকে উন্নতির দিকে এগিয়ে নেওয়ার গতি বুঝতে পেরেই স্বাধীনতা বিরোধী দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা তাকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে সেনাবাহিনীর বিপথগামী একটি দল হানা দেয়। এ সময় তারা বঙ্গবন্ধুসহ বাড়িতে থাকা পরিবারের সবাইকে একে একে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর শিশুপুত্র শেখ রাসেলও সেদিন ঘাতকের হাত থেকে রেহাই পায়নি। বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকায় সেদিন তাঁরা প্রাণে বেঁচে যান।
স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে চার বছরের মাথায় স্বপরিবারে হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ১৫ আগস্ট ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম এই হত্যাকাণ্ডে আরও শিকার হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ভাই শেখ আবু নাসের, বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশুপুত্র শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মণি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী বেগম আরজু মণি, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি ও তার মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য কৃষক নেতা আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তাঁর ছোট মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত, কনিষ্ঠ শিশুপুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত আবদুলাহ বাবু, ভাইয়ের ছেলে শহীদ সেরনিয়াবাত, আবদুল নঈম খান রিন্টু ও বঙ্গবন্ধুর জীবনরক্ষায় এগিয়ে আসা প্রধান নিরাপত্তা অফিসার কর্ণেল জামিল উদ্দিন আহমেদ।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মুক্তিযুদ্ধের চার মূলনীতি- ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র ভূলুণ্ঠিত হয়। জাতির অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছিলেন, তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। দেশে সামরিক অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থান, হত্যা এবং ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয়। একের পর এক সামরিক স্বৈরশাসনের পালা বদল হতে থাকে। সেইসঙ্গে সামরিক স্বৈরশাসকদের ছত্রছায়ায় দেশে স্বাধীনতাবিরোধী পরাজিত গোষ্ঠী, উগ্র সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান ঘটে। রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত হয় চিহ্নিত স্বাধীনতা বিরোধীরা।