আন্তর্জাতিক ডেস্ক :
সারাবিশ্বের ফুটবল ভক্তদের কাঁদিয়ে চিরবিদায় নেয়া কিংবদন্তি ফুটবলার আর্জেন্টিনার ফুটবল ইশ্বর ম্যারাডোনাকে ২৭ নভেম্বর শুক্রবার পারিবারিক আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে সমাহিত করা হয়েছে। এসময় তাঁর কিছু ঘনিষ্ঠ আত্মীয় এবং বন্ধু উপস্থিত ছিল। তবে ম্যারাডোনার কফিনে শেষ শ্রদ্ধা হিসেবে ফুলের মুকুট পাঠিয়েছিলেন তাঁরই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বি আরেক কিংবদন্তি ফুটবলার পেলে।
ম্যারাডোনাকে সমাহিত করার আগে সারাদিনই আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস্ আয়ার্সের রাস্তায় হাজার-হাজার মানুষ জড়ো হয়ে ম্যারাডোনার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে। এসময় রাজধানী-জুড়ে এক আবেগ-ঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এ সময় কেউ কাঁদছিলেন, কেউবা তাঁর জন্য দুহাত তুলে প্রার্থনা করছিলেন।
গত বুধবার (২৫ নভেম্বর) ৬০ বছর বয়সে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান ডিয়াগো আরমান্ড ম্যারাডোনা। তাঁর মৃত্যু বিশ্বজুড়ে শোকের আবহ সৃষ্টি করেছে। তবে তাঁর দেশ আর্জেন্টিনায় সেই শোক আরো বেশি অনুভূত হয়েছে। কারণ, আর্জেন্টিনার মানুষ ম্যারাডোনাকে জাতীয় বীর মনে করে।
ম্যারাডোনার মরদেহ যে কফিনে রাখা হয়েছিল সেটিকে আর্জেন্টিনার জাতীয় পতাকা এবং ১০ নম্বর জার্সি দিয়ে ঢেকে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের সামনে রাখা হয়েছিল জনগণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য হাজার হাজার মানুষ প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে আসলে এক পর্যায়ে মানুষের সারি এক কিলোমিটারের বেশি দীর্ঘ হয়।
করোনা সংক্রমণের আশঙ্কার মধ্যেও শোকার্ত মানুষ যখন কফিনের কাছে আসতে চেয়েছিল তখন তাদের সামাল দিতে পুলিশকে শক্তি প্রয়োগ করতে হয়েছে। এসময় পুলিশ টিয়ার গ্যাস এবং রাবার বুলেট ছুঁড়েছে। একপর্যায়ে ম্যারাডোনার কফিন জনসম্মুখে যে জায়গায় রাখা হয়েছিল সেখান থেকে সরিয়ে নেয়া হয়।
এরপর মোটর শোভাযাত্রায় ম্যারাডোনার মরদেহ বুয়েনস্ আয়ার্স শহরের উপকণ্ঠে বেল্লা ভিস্তায় সমাধিস্থলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বাবা-মায়ের কবরের পাশে ম্যারাডোনাকে অন্তিম শয়ানে রাখা হয়।
এদিকে ম্যারাডোনার শেষবিদায়ে ফুলের ‘মুকুট’ পাঠালেন ফুটবল বিশ্বের আরেক জীবন্ত কিংবদন্তি ব্রাজিলের বীর পেলে।
অথচ এই পেলে এবং ম্যারাডোনাকে সারাবিশ্বের ফুটবলপ্রেমিরা চিরপ্রতিদ্বন্দ্বি বলেই জানে। কে সেরা-এই প্রশ্নে যুক্তিতর্ক হয়তো কখনো শেষ হবে না। কিন্তু পেলে ভেতরে-ভেতরে ম্যারাডোনাকে যে ভালোবাসতেন, শ্রদ্ধা করতেন, সেটা না বললেও চলে। ম্যারাডোনার ক্ষেত্রেও কথাটা সমান প্রযোজ্য। আর্জেন্টাইন কিংবদন্তির শেষযাত্রায় পেলে তাই চুপ করে থাকতে পারেননি। ফুলের মুকুট ও আবেগঘন বার্তা পাঠিয়েছেন ম্যারাডোনাকে।
ম্যারাডোনাকে সমাহিত করা হয়েছে বুয়েনস্ আয়ার্স শহর থেকে একটু দূরে বেল্লা ভিস্তা সমাধিক্ষেত্রে। এর আগে আর্জেন্টিনার প্রেসিডেনশিয়াল ভবন কাসা রোসাদায় রাখা হয়েছিল ম্যারাডোনার কফিন। সেখানে শেষশ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাতে নেমেছিল জনতার ঢল। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষও হয়েছে ম্যারাডোনার ভক্তদের। পেলের পাঠানো শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার পুষ্পস্তবক বহনকারী গাড়ি তখন কাসা রোসাদায় ঢুকতে পারেনি। জনতা ঘিরে রেখেছিল গাড়িটি। কয়েক দফা চেষ্টা করেও গাড়িটি কাসা রোসাদায় ঢুকতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত সমাধিক্ষেত্র বেল্লা ভিস্তা নিয়ে যাওয়া হয় গাড়িটি। সেখানেই অর্পণ করা হয় পুষ্পস্তবক।
পেলের পাঠানো পুষ্পস্তবক মুকুটের আদলে হওয়ায় সম্ভবত সেটিকে ‘মুকুট’ সম্বোধন করা হয়েছে। হলুদ, সবুজ ও নীল ফুলে তা বানানো হয়েছে, ব্রাজিলের জাতীয় পতাকার সঙ্গে মিল রেখে। ছিল আর্জেন্টিনার পতাকাও। পুষ্পস্তবকের সঙ্গে একটি বার্তাও পাঠিয়েছেন পেলে, ‘ঈশ্বর তাকে প্রতিভা দিয়েছিলেন, পৃথিবী তাকে ভালোবেসেছিল- পেলে।’
ম্যারাডোনার মৃত্যুতে গোটা বিশ্ব যে শোকে মুহ্যমান হবে, সে তো জানাই। পেলের হৃদয়ও ভেঙেছে। সেটি তিনি বুঝিয়ে দেন ম্যারাডোনার মৃত্যুর পরপরই। সর্বকালের সেরার প্রশ্নে ম্যারাডোনার সঙ্গে যাঁর বিতর্ক জমেছে সবচেয়ে বেশি, সেই পেলে টুইট করেছিলেন, ‘কী দুঃখের খবর। আমি আমার অসাধারণ এক বন্ধুকে হারালাম। এখন অনেক কিছুই বলা হবে। আপাতত তার পরিবারকে শোক সহ্য করার শক্তি দিন সৃষ্টিকর্তা। আশা করি, আমরা একদিন স্বর্গে ফুটবল খেলব।’
ম্যারাডোনার সংক্ষিপ্ত ফুটবল ক্যারিয়ার :
১৯৬০ সালে ম্যারাডোনার জন্ম হয় আর্জেন্টিনার বুয়েন্স্ আয়ার্সের লানুসে। ১৯৭৬ সালে আর্জেন্টিনোস জুনিয়ার্সের হয়ে পেশাদার ফুটবল খেলার শুরু।
১৯৭৯ সালে প্রথম বিশ্বকাপ বিজয় আর্জেন্টিনার আন্ডার-টোয়েন্টি টিমের সাথে খেলেন।
১৯৮৬ সালে মেক্সিকোতে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে তাঁর বিখ্যাত “হ্যান্ড অফ গড” গোল। পশ্চিম জার্মানিকে হারিয়ে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়।
১৯৯৭ সালে ৩৭ বছর বয়সে নিজের জন্মদিনে পেশাদার খেলোয়াড় থেকে অবসরগ্রহণ।
২০০০ সালে ফিফার শতাব্দী সেরা খেলোয়াড় খেতাবে ভূষিত হন।
২০০৮ সালে দুবছরের জন্য আর্জেন্টিনার জাতীয় দলের কোচ নিযুক্ত হন। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত বিভিন্ন দলের ম্যানেজার ছিলেন।